সংঘর্ষ (প্রক্রিয়া)
সাধারণত সংঘর্ষ বলতে একাধিক বিরুদ্ধপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বা সংঘাতকে বোঝায়। মানব জীবনে সংঘর্ষ প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে। বিশ্বাস ও মূল্যবোধের বিচিত্রতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের বিভিন্নতা এবং ব্যক্তি, সামাজিক শ্রেণী, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে সংঘর্ষের উদ্ভব হয়। মোহামেদ রাবির মতে, "যেহেতু সংঘর্ষ মূল্যবোধ, বিশ্বাস, স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সম্পর্কিতp
Palash palashflict is about values, beliefs, interests and perceptions, it occures at every level of human and state interaction)".[১]
সংঘর্ষ সবসময় খারাপ অথবা নেতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসে তা নয়। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা যদি সংঘর্ষের রূপ নেয়, তবে ব্যক্তি আরও পরিশ্রমী হতে বাধ্য হয় এবং উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এছাড়া ক্লাসে ভাল ফলাফলের জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের রেষারেষি বজায় থাকে। প্রকৃতপক্ষে এই রেষারেষি বা সংঘর্ষ তাদের আরও ভাল ফলাফল করতে উদ্বুদ্ধ করে। আবার সব সংঘর্ষ মীমাংসাযোগ্য নয়। বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে প্রতিনিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। কিন্তু এ সংগ্রাম থেকে মুক্তি পাওয়া বা সংগ্রামের মূল সমস্যা সমাধান করার মত কোন সর্বজনগ্রাহ্য নীতিমালা এখন পর্যন্ত নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংঘর্ষ সবসময় ধ্বংসাত্মক বলে প্রমাণিত হয়নি। কখনও কখনও তা সম্পর্কে নতুন মাত্রা নিয়ে আসতে সমর্থ হয়।
সংজ্ঞা
[সম্পাদনা]সংঘর্ষের সাধারণ বাংলা দুইটি: এক, দুটি পক্ষের মধ্যে সহিংস ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া (Violent interaction) আর দুই, তাদের মধ্যে একটি আপোষহীন অবস্থান (Incompatible position)। যদিও এ দুটি অর্থ সংঘর্ষকে পুরোপুরি সংজ্ঞায়িত করে না, তবু এ সম্পর্কে আমাদের মোটামুটি ধারণা দেয়। প্রথম অর্থটি সংঘর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে, কিন্তু তা কেন সহিংস সে ব্যপারে কোন আলোকপাত করে না। দ্বিতীয় অর্থটি সংঘর্ষের আরও গভীরে যাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তা আপোষহীন অবস্থানের কারণগুলো কী কী, সে সম্পর্কে কোন ধারণা দেয় না। সংঘর্ষ ব্যাখ্যা করতে গেলে দুটি অর্থই আবশ্যক, কিন্তু দুঃখজনকভাবে এরা কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।
সংঘর্ষকে নানাজন নানাভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন, একেক জন একেক দিককে গুরুত্ব দিয়েছেন। একদল তাত্ত্বিক সংঘর্ষকে একটি মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক বা অবস্থা হিসেবে দেখেছেন। যেমন, কেনেথ ই. বল্ডিঙের মতে:
Conflict may be defined as a situation of competition in which the parties are aware of the incompatibility of potential future positions and in which each party wishes to occupy a position that is incompatible with the wishes of others.[২]
অর্থাৎ সংঘর্ষ হচ্ছে একটি পরিস্থিতি যেখানে পক্ষগুলো প্রতিযোগিতার ভবিষ্যৎ ফলাফলের যে অসামঞ্জস্যতা সেটা সম্পর্কে সচেতন থেকেই ফলাফলটি নিজেদের পক্ষে নেওয়ার আশা করে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, এ পরিস্থিতিতে পক্ষগুলো তাদের নিজ নিজ অবস্থান স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারে কিন্তু সে অনুযায়ী প্রত্যক্ষ আচরণ করে না। এ সংঘর্ষ যতটা না শারীরিক তার চেয়ে বেশি মনস্তাত্ত্বিক। একই রকম ধারণা আমরা পাই ডিন প্রিট আর জেফ্রি রুবিনের সংজ্ঞায়। তাদের মতে, সংঘর্ষ হচ্ছে-
...a perceived divergence of interest, or a belief that the parties' current aspirations cannot be achieved simultaneously.[৩]
এ সংজ্ঞায় অবশ্য সংঘর্ষের নতুন একটি দিক উন্মোচিত হয়েছে। সংঘর্ষে পক্ষগুলোর মধ্যকার আকাঙ্ক্ষা কোনোভাবেই একসাথে অর্জন করা সম্ভব হয় না।
ঠিক একই রকম ধারণা পাওয়া যায় রস স্ট্যাগনারের (Ross Stagner) সংজ্ঞায়। তবে তিনি কমপক্ষে দুটি পক্ষের কথা উল্লেখ করেছেন এবং এ পক্ষদু’টি ব্যক্তি, কোন গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র নয়। তার মতে:
Conflict is a situation in which two or more human beings desire goals which they perceived as being obtainable by one or the other but not both.[৪]
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর সবই সংঘর্ষকে একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় হিসেবে দেখেছে, শারীরিক বা আচরণগত বিষয় হিসেবে নয়। সংঘর্ষের এ সংজ্ঞায়নের মাধ্যমে পক্ষগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াবলী সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়।
আরেক দল তাত্ত্বিক সংঘর্ষকে একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় হিসেবে না দেখে একে অনেক বেশি ক্রিয়াশীল আর প্রত্যক্ষ হিসেবে কল্পনা করেছেন। সংঘর্ষের ইংরেজি conflict-এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থই “এক সাথে আঘাত করা” , যেটা একটা শারীরিক ক্রিয়া বোঝায়। এ ধরনের সংজ্ঞায় সংঘর্ষকে এক পক্ষের প্রতি আরেক পক্ষের একটা উন্মুক্ত ও আগ্রাসী আচরণ (কখনো শারীরিক) হিসেবে দেখানো হয়েছে। যেমন লুই কোসারের সংজ্ঞাটি লক্ষ্য করা যাক:
[Conflict is] a struggle over values and claims to scarce status, power and resources in which the aims of the opponents are to neutralize, injure or eliminate their rivals.[৫]
জোসেফ হাইমসের সংজ্ঞাটিও প্রায় এক রকম:
[Conflict] refers to purposeful struggles between collective actors who use social power to defeat or remove opponents and to gain status, power, resources and other scarce values.[৬]
আবার সংঘর্ষকে একটি সামাজিক পরিস্থিতি বলা যায় যখন দুটি পক্ষই একটি নির্দিষ্ট সময়ে একই লক্ষ্য আদায়ে সচেষ্ট হয়। এখানে নির্দিষ্ট সময়টি গুরুত্বপূর্ণ, যেমন ধরা যাক একটি ফুটবলের চাহিদা রয়েছে দুজন বালকের মধ্যে এবং তারা দুজনেই চায় বিকেলে বলটি দিয়ে খেলতে। সেক্ষেত্রে বালকদ্বয়ের মধ্যে একটি সাংঘর্ষিক সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু যদি বলটির চাহিদা দুজনের দুটি ভিন্ন সময়ে হয় তবে তাদের মধ্যে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক থাকবে না। পিটার ভালেনস্টিন সংঘর্ষ বিষয়ে বলেছেন:
A social situation in which minimum of two actors (parties) strive to acquire at the same moment in time an available set of scarce resources.[৭]
সংঘর্ষের চূড়ান্ত পর্যায়ে সহিংস আচরণের মাধ্যমে প্রতিটি পক্ষই তাদের উদ্দেশ্য সাধনে সচেষ্ট হবে। তবে এ সহিংস আচরণ আত্মরক্ষার জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। আবার সব সংঘর্ষই শারীরিক সহিংস আচরণের পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছে না। সি. আর. মিশেলের বক্তব্য এ ব্যাপারে দৃষ্টিগ্রাহ্য:
In Everyday use, it is often taken to mean some dispute in which two or more parties are using violence as a means of winning or more usually (as they perceived it) in self defense.[৮]
সংঘর্ষের সবচেয়ে সার্বজনীন আর সমন্বিত সংজ্ঞা পাওয়া যায় ম্যাক (R. W. Mack) আর শ্নাইডারের (R. C. Snyder) লেখায়। অবশ্য তারা সরাসরি কোন সংজ্ঞা দেননি, কোন ঘটনাকে সংঘর্ষ বলা যাবে কি যাবে না সে বিষয়ে চারটি শর্ত দিয়েছেন। প্রথমত, সংঘর্ষে অবশ্যই দুই বা ততোধিক পক্ষ থাকবে; দ্বিতীয়ত, সংঘর্ষ এমন একটি অবস্থা যাতে ক্ষমতা, অবস্থান বা সম্পদের ঘাটতি থাকবে; তৃতীয়ত, এমন আচরণের উপস্থিতি যার লক্ষ্য হচ্ছে অপর পক্ষকে শারীরিক বা মানসিকভাবে আহত করা; চতুর্থত, পক্ষগুলোর একই লক্ষ্য থাকবে যে লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে তারা আপোষহীন।[৯] তাহলে, সংঘর্ষ হচ্ছে দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে একটি আপাত নেতিবাচক সম্পর্ক যাতে পক্ষগুলো তাদের পারিপার্শ্বিক ক্ষমতা, অবস্থান বা সম্পদের ঘাটতি সাপেক্ষে একই সময়ে একই আপোষহীন এক বা একাধিক লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হয় এবং এ লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে সম্পূর্ণ নির্মূল বা আঘাত (শারীরিক বা মানসিক) করে বা করার চেষ্টা করে। সংজ্ঞাটিকে একটা সার্বজনীন সংজ্ঞা হিসেবে রায় দেয়া যায়। তার কারণ হল, সর্বোচ্চ সংখ্যক এবং সর্বোচ্চ প্রকারের সংঘর্ষ এই সংজ্ঞাটির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এ সংজ্ঞার মাধ্যমে আমরা ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত এবং রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সবধরনের সংঘর্ষের ব্যাখ্যা দিতে পারি। প্রাতিষ্ঠানিক সংঘর্ষ ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সংঘর্ষ, সমশক্তির সংঘর্ষ ও বিষমশক্তির সংঘর্ষ, শারীরিক সংঘর্ষ ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় এ সংজ্ঞাটির মাধ্যমে।
সংঘর্ষ অধ্যয়নের ইতিহাস
[সম্পাদনা]শুধুমাত্র সংঘর্ষ নিয়ে অধ্যয়নের ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পর্কে স্পষ্টভাবে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। ধর্মতত্ত্ব আর প্রাচীন-মধ্যযুগীয় দর্শনে সংঘর্ষ সম্পর্কে সরাসরিভাবে কিছু বলা হয়নি। প্রাচীন কালে সংঘর্ষ বলতে বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ অথবা গোষ্ঠীগত সহিংস মোকাবেলাকে বোঝানো হয়েছে।[১০] পরবর্তীতে সংঘর্ষের সমস্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে আর ঊনবিংশ শতাব্দীতে এটা এমন এক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেছিল যাতে সরকার এবং সামাজিক তাত্ত্বিক উভয়ের কেউই তা অগ্রাহ্য করতে পারেন নি। নেপোলিয়নীয় যুদ্ধ সে সময় পুরো ইউরোপকে নাড়া দিয়েছিল। এ সময় ইউরোপ এমন এক যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছিল যেটা কেউ আগে কখনও কল্পনাও করেনি। নেপোলিয়নের সামগ্রিক যুদ্ধ (Total war) ইউরোপের বৃহৎ শক্তিগুলোকে একত্র করে আর তাদের প্রথমবারের মত সংঘর্ষ সম্পর্কে কার্যকরভাবে ভাবিয়ে তোলে। যার ফলস্বরূপ রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে কূটনৈতিক সম্পর্কের সফল সূত্রপাত ঘটে।[১১]
দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি তৎকালীন রাষ্ট্রনায়ক আর সমাজ গবেষকদের ভাবিয়ে তুলেছিল, তা হল- ১৮৪৮ সালের বিপ্লব। ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা আর এশিয়ার কয়েকটি দেশে কাছাকাছি সময়ে এ বিপ্লব সংগঠিত হয়। মূলত শিল্পবিপ্লবের ফলে যে প্রচণ্ড দারিদ্র্য, ধনী-দরিদ্র বৈষম্য আর গণ-অভিবাসন ঘটেছিল, তা এই বিপ্লবের পেছনে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। বিপ্লবের অভিজ্ঞতা অর্জন করে কার্ল মার্ক্স আর ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস সর্বপ্রথম সংঘর্ষের ধারনাটি গুরুত্বের সাথে সামনে নিয়ে আসেন এবং শ্রেণীসংঘাতকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিশ্লেষণ করেন।[১২]
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাশেষি শ্রেণীর সাথে সাথে গোষ্ঠীর (Ethnicity) প্রশ্নও সংঘর্ষের ব্যাখ্যায় চলে আসে। গোষ্ঠীভিত্তিক জাতীয়তাবোধের (Ethnic nationalism) উন্মেষ ঘটানো হয় মূলত বিভিন্ন জাতীয় আর ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যভিত্তিক স্বার্থ ও নীতিমালা সংরক্ষণের জন্য। ইউরোপীয় সরকারগুলো তাদের ক্ষমতার লাগাম ধরে রাখবার জন্য তাদের উপনিবেশগুলোর ওপর গোষ্ঠী-পরিচয় (Ethnic identity) আর বর্ণশ্রেষ্ঠত্বের (Racial supiriority) ধারণা ব্যবহার করা শুরু করে। এসব ধারণা হানাহানি আর বিভেদকে আরও ত্বরান্বিত করে। এ সকল নিয়ামক বিবেচনা করে গেওর্গ জিমেল সর্বপ্রথম এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, আন্তঃগোষ্ঠীয় সংঘর্ষের সূত্রপাত অবচেতন ভাবে সৃষ্টি হয় না, বরং তা একটি সামাজিক প্রক্রিয়া।[১৩] সামাজিক ক্রিয়ার মধ্যে সম্মিলন-সংঘর্ষ আর ভালবাসা–ঘৃণা সবই একসাথে অন্তর্ভুক্ত থাকে। তার মতে, সমাজে যেসব ব্যক্তির হাতে গোপন তথ্য থাকে, তারাই মূলত ক্ষমতায় আসীন থাকেন। এসব তথ্যের ভিত্তিতে কিছু দলের সৃষ্টি হয় যারা নিজেরাই একটি সমাজের সৃষ্টি করে এবং বৃহত্তর সমাজের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
সংঘর্ষের স্বরূপ উন্মোচনকারী তৃতীয় ব্যক্তিটি হচ্ছেন মাক্স ভেবার। তার মতে, ক্ষমতা আর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন থেকেই উদ্ভব হয় সামাজিক সংঘাতের। মার্ক্সের মত তিনিও মনে করতেন, অর্থনীতি ক্ষমতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। আরও দুটি নিয়ামকের কথা তিনি উল্লেখ করেন, সামাজিক মর্যাদা আর রাজনৈতিক প্রভাব।[১৪] মার্ক্স, জিমেল, ভেবার- এদের বক্তব্য মূলত সামাজিক সংঘর্ষ নিয়ে আলোচনা করে, সংঘর্ষের সামগ্রিক সংজ্ঞা তাতে দেখা যায় না। অর্থাৎ তাদের বক্তব্যে গোষ্ঠী যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, রাষ্ট্র বা ব্যক্তি ততটা গুরুত্ব পায়নি। তবে সংঘর্ষের স্বরূপ উন্মোচনের যে অনুসন্ধান, তাতে এদের অবদান অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই।
বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের মধ্যে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পরাশক্তিগুলোর পারস্পরিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে ফেলে বিশ্ব। অভ্যন্তরীণ পরিমণ্ডলে শ্রমিক-মালিক সংঘর্ষ আর ত্রিশের মহামন্দা বিষয়গুলোকে আরও বেশি ঘোলাটে করে তোলে। বিশ্বজুড়ে শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা দেয়। সরকার আইন করে বিক্ষোভ দমানোর চেষ্টা করলেও তা খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়নি। পরবর্তীতে সমঝোতার (Negotiation) মাধ্যমে বিক্ষোভ মেটানোর ব্যবস্থা করা হয় এবং তাতে ফল দেয়। সমঝোতার পথ ধরে সংঘর্ষ বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন নতুন সংঘর্ষ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (Conflict management system) উদ্ভাবিত হতে থাকে। একই সাথে ‘সামষ্টিক দরকষাকষি’র (Collective bargaining) ধারণা ও প্রয়োগ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সংঘর্ষ-তাত্ত্বিকরা যখন অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছেন, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির দৃশ্যপটে। বিশ শতকের আধুনিক প্রযুক্তি আর আমলাতান্ত্রিক সংগঠন দেশগুলোকে এক অন্যরকম সামগ্রিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। সাধারণ জনগণ নিছক দর্শক না হয়ে এবার কৌশলগত লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা সংঘর্ষ বিশ্লেষণের প্রায়োগিক আর বুদ্ধিবৃত্তিক দুই ক্ষেত্রেই যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়। দ্য পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট (অসলো) এবং সেন্টার ফর কনফ্লিক্ট রেজ্যুলেশন (মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়) এ বিষয়ে প্রথম দিককার অ্যাকাডেমিক সংগঠন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এ বিষয়ক নানান প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয়, যেমন- ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট (স্টকহোম) আর ইন্সটিটিউট অফ পিস (যুক্তরাষ্ট্র)।
১৯৫০-৬০-এর পর থেকেই সংঘর্ষ অধ্যয়ন একটি আলাদা জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করে। সময়টা ছিল স্নায়ুযুদ্ধের। পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তারের সাথে সাথে প্রজাতি হিসেবে মানুষের টিকে থাকার প্রশ্নটি হুট করে সামনে চলে আসে। অন্য সব জ্ঞানকাণ্ডের কয়েকজন ব্যক্তি সর্বপ্রথম আলাদা এ জ্ঞানকাণ্ডের গুরুত্বটি টের পান আর এ বিষয়ে গবেষণায় ভ্যানগার্ডের ভূমিকা পালন করেন। সংঘর্ষ চর্চার পরিসীমা গোষ্ঠীগত সংঘর্ষের সীমানা পেরিয়ে আরও বিস্তৃত (আন্তর্জাতিক সংঘাত) কিংবা আরও সংকুচিত (ব্যক্তিগত সংঘর্ষ, এমনকি ব্যক্তিমধ্যস্থ সংঘর্ষ) হতে শুরু করে। মজার ব্যাপার হল, প্রথম দিকে এই ভ্যানগার্ডদের খুব একটা ভালো চোখে দেখা হয় নি। রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক আর পূর্বতন প্রতিষ্ঠানগুলো এর আগে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ নিয়ে কাজ করত। তারা এই উটকো আগন্তুকদের অনুপ্রবেশ প্রথমে মেনে নিতে পারেন নি। তারা নাখোশ হলেও সংঘর্ষচর্চা থেমে থাকে নি। মূলত তার পর থেকেই সংঘর্ষচর্চার একটা জোয়ার বিশ্বব্যাপী লক্ষ্য করা যায়। নতুন সব বৈশ্বিক সমস্যা সংঘর্ষচর্চার নতুন নতুন দিক ক্রমাগত উন্মোচিত করছে। পরিবেশ বিপর্যয়, মানবাধিকার, নারীবাদ, স্নায়ুযুদ্ধের অবসান, অরাষ্ট্রীয় পক্ষগুলোর (যেমন, বিভিন্ন এনজিও ও বহুজাতিক কর্পোরেশন) উত্থান, বিশ্বায়ন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রভৃতি বিষয় উঠে এসেছে সাম্প্রতিক সংঘর্ষচর্চায়। সংঘর্ষচর্চাকে কেবল একটি তত্ত্বনির্ভর জ্ঞানকাণ্ড ভাবলে ভুল হবে। বর্তমান সময়ে এটা যতটা না তাত্ত্বিক তার চেয়ে বেশি ব্যবহারিক।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Mohamed Rabie (১৯৯৪)। Conflict Resolution and Etnicity। Westport, CT, US: Praeger।
- ↑ Kenneth E. Boulding, Conflict and Defense: A General Theory (New York: Horper and Row, 1962), p. 5.
- ↑ Dean G. Pruitt and Jeffrey Z. Rubin, Social Conflict: Escalation, Stalemate, and Settlement (New York: McGraw-Hill Ryerson, Limited, 1986), p. 4.
- ↑ Ross Stagner (১৯৬৭)। The Dimensions of Human Conflict। Michigan: Wayne State University Press। পৃষ্ঠা 7।
- ↑ Lewis A. Coser (১৯৫৬)। The Functions of Social Conflict। New York: The Free Press। পৃষ্ঠা 7।
- ↑ Joseph S. Himes (১৯৮০)। Conflict and Conflict Management। Georgia: University of Georgia press। পৃষ্ঠা 14।
- ↑ Peter Wallensteen (২০০২)। Understanding Conflict Resolution: War, Peace and the Global System। London: SAGE Publications Ltd.। পৃষ্ঠা 16।
- ↑ C. R. Mitchell (১৯৮১)। The Structure of International Conflict। London: The Macmillan Press LTD.।
- ↑ R. W. Mack and R. C. Snyder (১৯৫৭)। "The Analysis of Social Conflict: Towards an Overview and Synthesis"। Journal of Conflict Resolution। 1 (2): 214–15।
- ↑ Quincy Wright (১৯৪২)। A Study of War। Chicago: University of Chicago Press। পৃষ্ঠা 4।
- ↑ Norman Davies (১৯৯৮)। Europe; A History। New York: HarperCollins। পৃষ্ঠা 786।
- ↑ Karl Marx and Friedrich Engels (১৯৯৮)। The Communist Manifesto, introduction by Martin Malia। New York: Penguin group। পৃষ্ঠা 35।
- ↑ George Simmel (১৯৫৫)। Conflict and the Web of Group Affiliations। New York: The Free Press। পৃষ্ঠা 8।
- ↑ Reinhard Bendix and Guenther Roth (১৯৭১)। Scholarship and Partisanship: Essays on Max Weber। University of California Press। পৃষ্ঠা 5–7।