বিষয়বস্তুতে চলুন

মঙ্গল আবাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মঙ্গলের বাসস্থানের জন্য বরফে আচ্ছাদিত ঘরের ডিজাইন

মঙ্গলে মানুষের বসবাস করার স্থান কে বলা হয় মঙ্গল আবাস (ইংরেজি:Mars Habitat)। [] আর মঙ্গল গ্রহে মানব বসতি স্থাপন করার এই মিশনকে বলা হয় মার্স ওয়ান মিশন (ইংরেজিতে: Mars One Mission)[]

বাস্তবে এই বাসস্থান তৈরী করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। প্রায় অক্সিজেনবিহীন বাতাস, চরম ঠান্ডা, উচ্চ বিকিরণ, এবং নিম্নচাপযুক্ত মঙ্গলের এই বাসস্থানগুলিকে অবশ্যই ভূপৃষ্ঠের অবস্থার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে।[] তবে এইধরনের সমস্যা থেকে পরিত্রানের জন্য আবাসস্থলটিকে ভূগর্ভস্থ রাখা যেতে পারে যদিও এতে নতুন সমস্যারও সৃষ্টি হবে। []

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

মঙ্গল গ্রহের আবাসস্থলের প্রথম দিকের ধারণাটি ছিল মঙ্গল গ্রহের অবতরণ-আরোহণ যানে (Ascent Descent Vehicle-ADV) সংক্ষিপ্ত থাকার ব্যবস্থা করা। এই ব্যবস্থাটি মঙ্গল ভ্রমণ মডিউল (ইংরেজিতে: Mars Excursion Module) নামে পরিচিত যা মহাকাশ যাত্রার অন্যান্য উপাদান যেমন বেসিক রোভার এবং বিজ্ঞান সরঞ্জাম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এর পরবর্তী মিশনগুলিতে সম্পূর্ণ আলাদা স্বাধীন আরোহণ-বিচরন বৈশিষ্ট্যযুক্ত আবাস্থলের দিকে বেশি জোর দেওয়া হয়।

২০১৩ সালে জেডএ আর্কিটেক্টস (ইংরেজিতে: ZA Architects) মঙ্গলে খনন রোবটদ্বারা ভূগর্ভস্থ আবাস তৈরীর প্রস্তাব করে।[] তারা ফিংগাল'স কেভ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি ইনটেরিয়র বেছে নেয় এবং মাটির নিচে এটি উচ্চশক্তির বিকিরণ থেকে বেশি সুরক্ষা পাবে বলে উল্লেখ করে। অন্যদিকে মঙ্গলে বাসস্থান তৈরী বনাম এর পৃষ্ঠে আবার ল্যান্ডিং ক্যাপসুল নির্মানের জন্য খননকারী রোবট পাঠানোর যে অসুবিধা তাও উল্লেখ করে। তাই এর বিকল্প হিসেবে চিন্তা করা হয় যে বাসস্থানটি মাটির উপর নির্মান করা হবে এবং বিকিরণ হতে রক্ষার জন্য পুরু বরফ ব্যবহার করা হবে। তবে এতে সমস্যা হলো বরফের এই পুরুত্ব বাসস্থানের অভ্যন্তরে দৃশ্যমান আলো আসতে বাধা প্রদান করবে।

এরপর ২০১৫ সালে শী (SHEE) নামের একটি প্রকল্প মঙ্গলের আবাসস্থলের জন্য মানবদ্বারা নির্মাণের বিপরীতে স্বয়ংক্রিয় নির্মাণ এবং এর প্রস্তুতির ধারণা উল্লেখ করে।[]

পর্যালোচনা

[সম্পাদনা]

মঙ্গলে বাসস্থানগুলির একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো কৃত্রিম পরিবেশ বজায় রাখা এবং তীব্র সৌর বিকিরণ হতে উক্ত পরিবেশকে সুরক্ষা দেওয়া। এছাড়া সেখানে বসবাসকারী মানুষদের যেমন একটি চাপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন তেমনি বিষাক্ত মঙ্গল-বায়ুমন্ডল থেকে তাদের রক্ষা করাও প্রয়োজন।

সবচেয়ে বড় বিষয়, মঙ্গলে যাওয়ার অর্থ হলো পৃথিবীর এই অভ্যস্ত বায়ুমন্ডল ত্যাগ করা, মঙ্গলের পথে যাত্রা চলমান রাখা এবং পরিশেষে মঙ্গলপৃষ্ঠে নিরাপদে অবতরন করা যা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। যদিও মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে 'বায়ুমন্ডলীয় গতিরোধ' (Aerobraking) বলে একটি সুবিধা পাওয়া যায় ফলে নভোযান এর নিরাপদ অবতরণের জন্য অল্প পরিমানে প্রপেল্যান্ট(propellant) ব্যবহার করলেই হয়। যাই হোক, মঙ্গলপৃষ্ঠে বস্তু-সামগ্রী স্থানান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির পরিমান মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশের পূর্বে একট অতিরিক্ত কাজ। ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 'Satrun V' নামের একটি রকেট তৈরী করে যেটি প্রয়োজনীয় ভরসহ তিনজন যাত্রী নিয়ে চাঁদের কক্ষপথে উৎক্ষেপিত হতে এবং পৃষ্ঠে অবতরনের পর আবার ফিরে আসতে সক্ষম ছিল। এই কাজের জন্য বিশেষ ভাবে ডিজাইন করা কয়েকটি হার্ডওয়্যার এবং লুনার অরবিট রেন্ডেজভাস (Lunar Orbit Rendezvous) নামক এক প্রযুক্তির বিকাশের প্রয়োজন ছিল।

এই একই প্রযুক্তি মঙ্গলের জন্যেও ব্যবহার করার চিন্তা করা হয়। তবে তার জন্য প্রয়োজন 'মঙ্গল-ভ্রমণ মডিউল' (Mars Excursion Module) যা যাত্রীদের জন্য অবতরণ-আরোহণ যান (Ascent Descent Vehicle-ADV) এবং স্বল্প সময়ের জন্য মঙ্গলে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। পরে এই পরিকল্পনা পরিবর্তন করে অবতরণ-আরোহণ যান (ADV) এবং পৃষ্ঠের বাসস্থান কে আলাদা করা হয় ও নতুন ডিজাইন এর আর্কিটেকচার অনুযায়ী আলাদাভাবে অবতরণ, মঙ্গলপৃষ্ঠে অবস্থান এবং আরোহণের জন্য যান (Descent Vehicle) ব্যবহার করা হয়। ২০১০ সালে 'স্পেস লঞ্চ সিস্টেম'এর ওরিয়ন ক্যাপসুল (Orion Capsule) ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের মঙ্গল মিশনের জন্য প্রয়োজনীয় পে লোড ধারণক্ষমতা এবং দক্ষতা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

মঙ্গল আবাসের একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হলো আবহাওয়া বজায় রাখা, বিশেষ করে সঠিক জায়গায় সঠিক তাপমাত্রা।[]

মঙ্গল গ্রহের বাসস্থান এর একটি ধারণা হলো মার্টিন গুহা বা লাভা নল এর ব্যবহার। Caves of Mars Project এ জাতীয় কাঠামোতে এয়ারলক (Air-Lock) এরও প্রস্তাব করে।[] এই ভূগর্ভস্থ বাসস্থানের একটি সুবিধা হলো তেজস্ক্রিয়তা থেকে সুরক্ষার জন্য পৃষ্ঠের উপরে আলাদাভাবে কিছু তৈরী করা লাগে না।

মঙ্গলের বসবাস এর পরিকল্পনাতে খাবার এবং বাতাস সরবরাহের জন্য উদ্ভিদ বা অন্যান্য জীব এর ব্যবহার প্রভাব বিস্তার করে। মঙ্গলের বাসিন্দাদের বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে এই আবাসস্থলে নির্দিষ্ট ধরনের উদ্ভিদ জীবিত রাখার দিকে নজর দেওয়া লাগতে পারে।[]

নাসা 'কেভস অব মারস প্রজেক্ট' (Caves Of Mars Project) এর গবেষণায় মঙ্গলের বাসিন্দাদের খাবার ও জৈবিক সহায়তার জন্য যে উদ্ভিদ নির্বাচনে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য গুলো কে প্রাধান্য দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।[]

  • অত্যধিক ফলন
  • স্বল্প আলোতে টিকে থাকা
  • বিস্তৃত পি.এইচ পরিসর(রেঞ্জ)
  • অধিক পুষ্টিযুক্ত
  • স্বল্প অপব্যয়

এই গবেষণায় দুইটি উদ্ভিদ যথা ডাকউইড (Lemna minor) এবং ওয়াটার ফার্ন (Azolla filiculoides) কে বিশেষভাবে উপযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। []

মঙ্গল পৃষ্ঠে অন্যান্য উপাদানগুলির সাথে একত্রে মঙ্গল গ্রহের আবাস(শিল্পকর্ম)

প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম

[সম্পাদনা]
ওরিয়ন স্পেসক্রাফট(Orion SpaceCraft)

মঙ্গলে আবাস স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির কিছু সম্ভাব্য ক্ষেত্রঃ

Desert Research and Technology Studies এর মঙ্গল আবাস প্রদর্শন ইউনিট

২০১৫ সালের প্রথমদিকে নাসা তিনটি পর্যায়ে মঙ্গল আবাসের নকশা তৈরী ও নির্মাণ বিষয়ক প্রতিযোগিতার জন্য ধারনামূলক রূপরেখা দেয়। প্রথম পর্যায়টি ছিল শুধুমাত্র নকশা প্রণয়ন। তারপরের পর্যায়ে পরিত্যক্ত মহাকাশযান এর উপাদান ব্যবহার করে প্রযুক্তির নির্মাণ ও সর্বশেষ পর্যায়ে থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে মঙ্গল গ্রহের জন্য প্রকৃত আবাস তৈরী।[১০]

২০১৫ এর সেপ্টেম্বরে নাসা থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে মঙ্গল আবাস প্রতিযোগিতার (3-D Printed Habitat Challenge) প্রথম ধাপ (phase) এ Cloud Architecture Office/SEArch এর মার্স আইস হাউজ (Mars Ice House) শীর্ষক প্রজেক্টকে বিজয়ী ঘোষণা করে।[১১] এই প্রজেক্টে মূল মডিউল ল্যান্ডার(Module Lander) এর চারপাশে দ্বিস্তরী বরফ আচ্ছাদনের কথা উল্লেখ করা হয়। [১২]

২০১৮ সালের জুন মাসে নাসা উক্ত প্রতিযোগিতার শেষ ধাপের জন্য চূড়ান্ত ১০ প্রতিযোগী নির্বাচন করে।[১৩]

২০১৯ এর মে মাসে নাসা 3D-printed Mars Habitat Challenge এর চূড়ান্ত বিজয়ী হিসেবে Ai SpaceFactory এর মার্শা (Marsha) শীর্ষক প্রজেক্টকে নির্বাচন করে। এই শেষ দিনে প্রতিযোগীদের রোবোটিক নির্মাণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১/৩ স্কেল এর মডেল তৈরীতে ৩০ ঘণ্টা সময় লেগেছিল।[১৪]

আরো দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Starr, Michelle। "3D-printable ice house could be our home on Mars"CNET (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০১ 
  2. "Mission"Mars One (english ভাষায়)। ২০২০-০৯-০৩ তারিখে bring%20us%20all%20closer%20together. মূল |ইউআরএল= এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০১ 
  3. "8 Printable Martian Habitat Designs That We Want To Live In"Popular Science (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০১ 
  4. Shubber, Kadhim (২০১৩-০৯-০৬)। "Concept for underground Mars habitat marks dawn of Martian mole-people"Wired UK (ইংরেজি ভাষায়)। আইএসএসএন 1357-0978। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০১ 
  5. September 2015, Leonard David 16। "Future Mars Explorers Could Live in Habitats That Build Themselves"Space.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০১ 
  6. "Discover Magazine"www.discovermagazine.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৩ 
  7. "Air Lock"। ২০০৭-০৮-০৭। Archived from the original on ২০০৭-০৮-০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৩ 
  8. "Greenhouses for Mars | Science Mission Directorate"science.nasa.gov। ২০১৭-০৫-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৩ 
  9. "Flat Crops for Mars"। ২০২০-০৭-০১। Archived from the original on ২০০৭-০৭-০১। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৩ 
  10. Maynard, James (২০১৫-০৫-১৯)। "NASA Offers $2.25 Million For Martian Habitat Design - How Could This Contest Help People On Earth?"Tech Times (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৩ 
  11. Harbaugh, Jennifer (২০১৫-০৯-২৭)। "NASA Awards Top Three Design Finalists in 3D Printed Habitat Challenge"NASA। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৩ 
  12. "MARS ICE HOUSE — Clouds Architecture Office"cloudsao.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৩ 
  13. Harbaugh, Jennifer (২০১৮-০৬-২৮)। "Top 10 Teams Selected in Virtual Stage of 3D-Printed Habitat Challenge"NASA। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৩ 
  14. May 2019, Elizabeth Howell 10। "Here's the Winner of NASA's 3D-Printed Mars Habitat Challenge"Space.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৩