রেফারী
রেফারী (ইংরেজি: referee) দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে নির্দিষ্ট যে-কোন ধরনের খেলা পরিচালনা করেন। পাশাপাশি তিনি নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সকল ধরনের সিদ্ধান্ত দ্রুত প্রয়োগের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে সংশ্লিষ্ট খেলা পরিচালনা করেন। খেলার পরিচালক হিসেবে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক খেলায় দুইপক্ষের খেলোয়াড়দের ভুল-ত্রুটি নির্দেশ করেন।[১] অধিকাংশ খেলায় মধ্যস্থতাকারীরূপে তিনি হুইসেল বা বাঁশী বাজান। খেলায় অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়গণ এ বিশ্বাসটুকু উপলদ্ধি করেন যে, বিচারক হিসেবে একজন রেফারীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং তিনি সর্বদাই সঠিক সিদ্ধান্ত দেন, যদিও অনেকক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্ত ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। যদি কোন কারণে কোন খেলোয়াড় তাঁর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় বা মানতে অবাধ্য হয়, তাহলে ঐ খেলোয়াড় হলুদ কার্ড কিংবা লাল কার্ড প্রাপ্তির মাধ্যমে মাঠ থেকে বহিস্কৃত হতে পারেন।
খেলা পরিচালনাকারী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পদবী খেলার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন সমার্থক নামে ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে পরিচিত। তন্মধ্যে - আম্পায়ার, জাজ, আরবিটার বা বিচারক, আরবিট্রেটর বা মধ্যস্থতাকারী, লাইন্সম্যান, কমিসেইর, টাইমকিপার বা টাচ জাজ ইত্যাদি।
উৎপত্তি
[সম্পাদনা]রেফারী শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে ফুটবল খেলা থেকে। প্রকৃতপক্ষে দলের অধিনায়কগণ একে-অপরের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মাঠের সমস্যাগুলো সমাধান ও নির্ধারণ করে থাকেন। ঘটনা পরম্পরায় একজন রেফারী আম্পায়ার পদবীর প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রত্যেক দলই দলীয় অধিনায়কের অনুমোদনক্রমে খেলায় মনোযোগের জন্য তাদের দলীয় আম্পায়ার আনেন। পরবর্তীকালে একজন তৃতীয় নিরপেক্ষ কর্মকর্তাকে খেলায় সংশ্লিষ্ট করা হয়। আম্পায়ারগণ কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে ব্যর্থ হলে একজন রেফারী সমস্যা সমাধানের জন্য প্রেরিত হন। ১৮৯১ সালের পূর্ব পর্যন্ত খেলায় রেফারীর কোন ভূমিকা ছিল না। আম্পায়ারগণ লাইন্সম্যানরূপে তাদের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মাঠে রেফারীর আগমন ঘটে। লক্ষণীয় যে, লাইন্সম্যান বা লাইন্সওম্যানগণই বর্তমানে সহকারী রেফারী নামে পরিচিত।
আজকাল অনেক শৌখিন ফুটবল খেলায় উভয় পক্ষ থেকে তাদের নিজস্ব সহকারী রেফারী সরবরাহ করেন যা সচরাচর ক্লাব লাইন্সম্যান নামে পরিচিত হন। তারা ফুটবল সংস্থার মনোনীত ও নিরপেক্ষ রেফারীকে সহায়তা করে থাকেন।
ভূমিকা
[সম্পাদনা]যে-কোন ধরনের খেলায় রেফারী প্রধান বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। খেলায় যথাযথ নিয়ম-কানুন অনুসরণ ও প্রয়োগের মাধ্যমে খেলা পরিচালনাসহ খেলোয়াড়দেরকে খেলোয়াড়ীসুলভ মনোভাবের মাধ্যমে খেলা প্রদর্শনে সচেষ্ট হন। তাঁর বাঁশি ফুৎকারের মাধ্যমে যেমন খেলা শুরু হয়; তেমনি ঐ বাঁশির দীর্ঘ ফুৎকারে খেলা শেষ হয়। প্রত্যেক রেফারীকেই খেলার যাবতীয় নিয়ম-কানুন সম্পর্কে সম্যক অবগত হবার জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। খেলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে তিনি যেমন সকলের প্রশংসা কুড়ান, তেমনি ভুল সিদ্ধান্তে কোন দল ক্ষতিগ্রস্ত হলে ধিক্কার পান। অনেকক্ষেত্রে তাঁর ভুল সিদ্ধান্তের জন্যে খেলা পরিত্যক্ত হতে পারে।
ক্রিকেট
[সম্পাদনা]ম্যাচ রেফারী মাঠের বাইরে অবস্থানকারী কর্মকর্তা হিসেবে থাকেন। তিনি বিচারকরূপে ক্রিকেট খেলায় যাবতীয় নিয়ম-কানুনের যথাযথ প্রয়োগ এবং আইসিসি প্রণীত আচরণবিধি অপব্যবহারে জরিমানা নির্ধারণ করেন। কিন্তু মাঠে অবস্থানকারী দুই জন আম্পায়ারই প্রধান ক্রিকেট খেলা পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা রাখেন। তবে, একান্ত প্রয়োজন পড়লে কিংবা নিখুঁত সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্যে মাঠের বাইরে অবস্থানরত থার্ড আম্পায়ার তাঁকে যোগ্য সঙ্গ দিয়ে থাকেন।
ফুটবল
[সম্পাদনা]একজন রেফারীর মাধ্যমে ফুটবল খেলা পরিচালিত হয়। ফুটবলের আইন-কানুনের ৫নং ধারার মাধ্যমে রেফারীকে খেলা পরিচালনার জন্য মনোনীত করা হয়। তিনি খেলায় মূল কর্তৃপক্ষ হিসেবে যাবতীয় আইন-কানুন প্রয়োগ করেন। দুইজন সহকারী রেফারী বা লাইন্সম্যান এবং কখনো কখনো চতুর্থ রেফারীও তাঁকে খেলায় সহায়তা করে থাকেন। তবে ইউইএফএ ফুটবল প্রতিযোগিতায় ৬জন রেফারী অংশগ্রহণ করেন। দুইজন গোলপোস্টের বাইরে থেকে বলের অবস্থান চিহ্নিত করেন যে তা গোল লাইন অতিক্রম করেছে কি-না।
খেলা নির্দিষ্ট সময়ে সমাপণ কিংবা অতিরিক্ত সময় যুক্তকরণ তাঁর দায়িত্ব। মাঠে অবস্থানকালে যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় পরখপূর্বক খেলোয়াড় সংখ্যার সঠিকতা, অতিরিক্ত খেলোয়াড়ের সংশ্লিষ্টতা, ইত্যাদি ঘটনার বিবরণ নোটবহিতে লিপিবদ্ধসহ খেলাশেষে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পেশ করেন। এছাড়াও, খেলোয়াড় আহত ও এর গুরুত্বতা অনুধাবনপূর্বক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ হিসেবে স্ট্রেচার আহ্বান করেন। মাঠে তিনি কোন খেলোয়াড়, এমনকি দলীয় কোচকে হলুদ কিংবা লাল কার্ডের প্রয়োগের মাধ্যমে যথাক্রমে সতর্কীকরণ, শাস্তি কিংবা বহিস্কার করতে পারেন।
বিশ্বব্যাপী ফুটবল খেলার মানোন্নয়নে সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী সংস্থা ফিফা ১৭টি আইনের কথা উল্লেখ করেছে। তন্মধ্যে - রেফারী এবং সহকারী রেফারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে তুলে ধরা হয়েছে।
যথাযথভাবে খেলা পরিচালনার জন্য প্রতিযোগিতা কর্তৃপক্ষ রেফারীদের প্যানেল সৃষ্টি করতে পারেন। ২০০৬ সালে বিশ্বকাপে ফুটবলে আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ ৫ম বিচারকের ব্যবস্থা রেখেছিল, যার কাজ হচ্ছে ম্যাচ রেফারীকে সাহায্যে করা।
হ্যান্ডবল
[সম্পাদনা]বহিরাঙ্গনের খেলা হিসেবে আন্তর্জাতিক হ্যান্ডবল সংস্থার আইন-কানুন মোতাবেক হ্যান্ডবল খেলার দুই প্রান্তে সমান মর্যাদাসম্পন্ন দুইজন রেফারীর মাধ্যমে খেলা পরিচালিত হয়।[২] তাদেরকে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করেন একজন টাইমকিপার বা সময় সংগ্রাহক এবং স্কোরকিপার বা ফলাফলরক্ষক।[৩]
বেসবল
[সম্পাদনা]বেসবল খেলা তত্ত্বাবধানের জন্য আম্পায়ার আনুষ্ঠানিকভাবে রেফারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সচরাচর দুই, তিন বা চারজন আম্পায়ার এ খেলায় অংশগ্রহণ করেন। তবে প্রতিযোগিতামূলক বেসবল ক্রীড়ায় কখনো কখনো ছয়জন আম্পায়ারও থাকতে পারেন।
বক্সিং
[সম্পাদনা]মুষ্টিযুদ্ধ বা বক্সিং খেলায় রেফারী লড়াইয়ের নিয়ম-কানুন প্রতিপালন করেন। তিনি খেলোয়াড়দ্বয়কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা, খেলা শুরু কিংবা কোন প্রতিযোগীর ভূপাতিত হওয়া, স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা খেলোয়াড়ের অসামর্থতাজনিত কারণে খেলা বন্ধ রাখাসহ বিজয়ী নির্ধারণে অংশগ্রহণ করেন।
বাস্কেটবল
[সম্পাদনা]আন্তর্জাতিক বাস্কেটবল এবং কলেজ বাস্কেটবল খেলায় রেফারী প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে বিবেচিত হন। তাকে সঙ্গ দেন এক বা দুইজন আম্পায়ার। ন্যাশনাল বাস্কেটবল এসোসিয়েশনে প্রধান কর্মকর্তাকে ক্রু চিফ এবং অন্য দু'জন কর্মকর্তাকে রেফারীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। বাস্কেটবল খেলায় সকল কর্মকর্তাকেই প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে আখ্যায়িত করলেও সমষ্টিগতভাবে তারা কর্মকর্তা অথবা ভুল ব্যাখ্যায় রেফারী বলে ডাকা হয়।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, প্রধান সম্পাদকঃ ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, ২য় সংস্করণ, ২০০৯, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃষ্ঠাঃ ১০৩৯
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি" (পিডিএফ)। ২৬ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ মে ২০১২।
- ↑ International Handball Association, Rules of the Game, 1 August 2005