হরতাল
হরতাল শব্দটি মূলত একটা গুজরাটি শব্দ (গুজরাটিতে હડતાળ বা હડતાલ হ্যড়্তাল্) যা সর্বাত্মক ধর্মঘটের প্রকাশক। মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন।[১] এটা হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত আন্দোলন। হরতালের সময় সকল কর্মক্ষেত্র, দোকান, আদালত বন্ধ থাকে। তবে সাধারণত অ্যাম্বুলেন্স, দমকলবাহিনী, গণমাধ্যমসমূহ এর আওতার বাইরে হয়ে থাকে।[২]
এটা সাধারণত কোনো একটা দাবি আদায় করার বা এর গুরুত্ব বোঝাতে আহ্বান করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, দ্রব্যমূল্যের অত্যধিক বা ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি রোধ করার ক্ষেত্রে সরকারি দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এর ব্যবহার। এছাড়াও বিভিন্ন কারণে হরতাল ডাকা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকার সমর্থিত নয়, এমন সংগঠন, কিংবা বিরোধী দল হরতালের আহ্বান করে থাকে। তবে অরাজনৈতিক কোনো দলও, সরকার-সমর্থিত হওয়াসত্ত্বেয় সরকারের কোনো কাজের বিরোধিতা করতে হরতালের ডাক দিতে পারে।
হরতাল, রূপভেদে বিশ্বের প্রায় সব দেশে বর্তমান থাকলেও[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ভারতীয় উপমহাদেশেই এই রাজনৈতিক হাতিয়ারটির ব্যবহার বেশি দেখা যায়।[২]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]বৈশ্বিক ইতিহাসে প্রথম দিকে রেকর্ড করা হরতাল অ্যাকশনটি ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১১৭০ সালের দিকে। তৎকালীন দাইর আল মদিনা যেটি বর্তমান মিশর সেখানকার মন্দিরের কর্মীরা তাদের দাবি আদায়ে প্রথম স্ট্রাইক বা আমাদের পরিচিত হরতাল পালন করে। এরপর ষোড়শ শতাব্দীতে স্ট্রাইক হয় ইংল্যান্ডে। পরবর্তী সপ্তদশ শতাব্দীতে এটি জনপ্রিয়তা পায়। তারপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দাবি আদায়ের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে হরতাল। আঠারো ও উনিশ শতকে ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই নিয়মিতভাবে পালিত হয় হরতাল। আর বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে এমন কোনো বছর ছিল না যে যখন কোনো হরতাল পালিত হয়নি। উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে পালিত হয়েছে হরতাল। এসব হরতাল পালন করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও নাগরিক সংগঠন; তবে এতে বেশি অবদান ছিল রাজনৈতিক দলগুলোরেই।
'''''ভারতীয় উপমহাদেশে হরতালের ইতিহাস'''''
রংপুরের প্রজা সমাজ ১৭৮৩ সনে ইজারাদার দেবী সিংহের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ডিং বা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ডিং ছিল দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত খাজনা দেয়া বন্ধ রাখার আন্দোলন। এই আন্দোলনে প্রজারা সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বিদ্রোহ প্রকাশ করেছিল সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। রংপুরের প্রজাদের এই ডিং আন্দোলনের আদলে পরবর্তী সময়ে যশোহর-নদীয়া-পাবনার নীলচাষীদের ডঙ্কা আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৮৫৯-৬০ সনের এই আন্দোলনে বাংলার নীল চাষিরা ডঙ্কা বাজিয়ে ঘোষণা দেয় যে, তারা আর নীল চাষ করবে না। একটি ডঙ্কার আওয়াজ শোনামাত্র দূরে আরেকটি ডঙ্কা বাজানো মানে ছিল সেখানেও ওই আন্দোলনের শরিকরা সংহতি ঘোষণা করছে। একইভাবে ১৮৫০ ও ১৮৬০-এর দশকে ফরায়জি আন্দোলনের কৌশল ছিল জোট। জমিদার কর্তৃক বেআইনি ও অন্যায়ভাবে আরোপিত আবওয়াব (খাজনাতিরিক্ত চাঁদা) আদায়ের বিরুদ্ধে প্রজারা জোট গঠন করে প্রতিরোধ রচনা করে। প্রতি পরগণায় কৃষকদের নিয়ে জোট গঠন করা হয়। স্থানীয় জোটগুলো সংশ্লিষ্ট হয় আঞ্চলিক জোটের সঙ্গে। আঞ্চলিক জোট সমন্বয়ে গঠিত হয় কেন্দ্রীয় জোট। ১৮৭৩ সালের পাবনা কৃষক বিদ্রোহ সংগঠকরা যে আন্দোলন পরিচালনা করে তা ছিল আজকের ধর্মঘটের অনুরূপ। ধর্মঘট হচ্ছে হিন্দু কৃষক পরিবারের এক দেবতার প্রতীকস্বরূপ পাত্র। এই পাত্র স্পর্শ করে প্রজারা প্রতিজ্ঞা করে যে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত খাজনা হারের উপরে তারা কোনো বাড়তি খাজনা দেবে না।[৩]
কার্যক্রম
[সম্পাদনা]শান্তিপূর্ণ হরতালের মূল কার্যক্রম হয়ে থাকে প্রতিবাদ মিছিল এবং সমাবেশ। অর্থাৎ হরতাল সমর্থকরা রাজপথে বেরিয়ে একত্র হয়ে উচ্চস্বরে নিজেদের দাবি-দাওয়া জানান দিয়ে থাকেন। কিন্তু কখনও কখনও এই পদ্ধতির ব্যবহার করতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়া, কিংবা আইনবহির্ভুত কাজে নেমে যাওয়া হরতালকে শান্তিপূর্ণ রাখে না। তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হরতাল সমর্থকদের বাধা দিতে বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার করে থাকেন। এধরনের দাঙ্গা মোকাবেলায় পুলিশের বিশেষ দাঙ্গা বাহিনী নিয়োজিত হয়ে থাকে। পুলিশি সাধারণত লাঠি দিয়ে আঘাত করা (লাঠিচার্জ), গরম পানি ছিটিয়ে দেয়া, কাঁদানে গ্যাস (টিয়াল শেল) ছুঁড়ে দেয়া, কিংবা রাবার-বুলেট দিয়ে গুলি করে আহত করে হরতাল সমর্থকদেরকে ছত্রভঙ্গ করা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে পুলিশও বেআইনিভাবে বন্দুকের বাট, কিংবা বুট দিয়ে পিকেটারদের উপর চড়াও হতে দেখা গেছে। পুলিশের এই মারমুখী আচরণ অধিকাংশ সময়ই হরতাল সমর্থকরা সুনজরে দেখেন না। এবং এজন্য তারা পাল্টা আক্রমণ করতে ইট-পাটকেল ছোঁড়েন কিংবা নিরাপত্তা বাহিনীর ছুঁড়ে দেয়া টিয়ার শেল তুলে আবার নিরাপত্তা বাহিনীর দিকেই ছুঁড়ে মারেন। এতে অনেক ক্ষেত্রেই উভয়পক্ষেই হতাহতের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এসকল ক্ষেত্রে ধৃত পিকেটারদের পুলিশ গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যায়।
হাতিয়ার ও নৈরাজ্য
[সম্পাদনা]হরতালের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো হরতালকারীদের কন্ঠস্বর। সাধারণত তারা রাজপথে বেরিয়ে চিৎকার করে নিজেদের দাবি-দাওয়া জনসমক্ষে কিংবা গণমাধ্যমের সামনে পেশ করে থাকেন। তবে মিছিল করার ক্ষেত্রে অনেক সময় ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার ইত্যাদির ব্যবহার হয়ে থাকে। এই ধারণায় মিছিল, হরতালের অনেক বড় একটা হাতিয়ার। তাছাড়া হরতাল সমর্থকরা টায়ারে আগুন লাগিয়ে হরতাল পালন করে। ইট পাথর নিক্ষেপ, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ ও হয়ে থাকে। হরতালের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে গাছপালা কেটে রাস্তা অবরোধ, ট্রেনের স্লিপার খুলে ফেলা হয়। যাতে চরম দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ।
আইনি দৃষ্টিকোণ
[সম্পাদনা]হরতাল কোনো দেশের জনগণের আইনসিদ্ধ হাতিয়ার।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] কিন্তু হরতালের নামে নৈরাজ্যকারীদের সরকার কঠোর হস্তে দমন করে। এর আওতায় কখনও কখনও রাজনৈতিক প্ররোচনায় শান্তিপূর্ণ হরতালকারীও সাজাপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। সাধারণত হরতালে অন্যায় করে থাকলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিক পিকেটারদের গ্রেফতার করে হাজতে নিয়ে যান। কিন্তু ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সরকার, হরতালকারী কিংবা হরতালের নামে নৈরাজ্যকারীদের তাৎক্ষণিক সাজা দিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ব্যবস্থা করেছে, এবং এই আদালত পুলিশি গ্রেফতারের সাথে সাথে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতারকৃতকে বা গ্রেফতারকৃতদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়ে থাকেন। এই আদালতের বৈধতা বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ একমত নন।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ হরতাল না ভয়তাল। ঢাকা থেকে প্রকাশের তারিখ: ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ।
- ↑ ক খ যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে হরতাল কিসের?। মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার, যুগান্তর। ঢাকা। প্রকাশের তারিখ ০৮ নভেম্বর, ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ।
- ↑ "যেভাবে শুরু হলো হরতাল"। thedailycampus.com (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৩-১০-২৮। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১১-০৭।
http://www.dhakatribune.com/juris/2015/jan/29/how-and-why-are-hartals-legal ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে
এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |