বিষয়বস্তুতে চলুন

আমার আত্মকথা/সাত

উইকিসংকলন থেকে

সাত

 মানুষ গড়ে, দেবতা ভাঙে। আমরা আশার ছলনে ভুলে কতবারই যে কত জায়গায় কত রকমেই না আমাদের খেলাঘর সাজাচ্ছি, আমাদের এত সাধের সাজানো বাগান পাতছি আর ততবারই কে যেন অদৃশ্য তার হাত খানা বাড়িয়ে সব গুলিয়ে দিচ্ছে। স্ত্রী মরছে, কেঁদে কেটে ‘ভগ্নহৃদয়’ লিখে সুখের কাঙাল মানুষ আবার একটি রূপের ডালি ষোড়শী খুঁজে পেতে এনে, ভাঙা সংসার নতুন করে গুছিয়ে বসছে। সন্তানহারা মা চুল ছিঁড়ে বুক দু’দশ দিন চাপড়ে কেঁদে আবার উঠে বসছে; বাদ বাকি সন্তান ক’টিকে নিয়ে আবার হাসছে —আদর সোহাগে তাদের সান্ত্বনার আঁচলে ঘিরে নিয়ে। তাই কি এক চোখো বিধির সইছে?

 হয়তো আমাদের ভাল সেই-ই বোঝে ভাল। ঝড় ঝাপটায় এই নিরন্তর বেড়ালছানা নাড়ানাড়িতেই হয়তো আমরা শক্ত সমর্থ হয়ে গড়ে উঠতে পারি। একটানা সুখের নীড়ের আওতায় গজানো আমাদের পলকা নধর জীবন হয়তো ষড় ঋতুর পরিবর্ত্তনে বেঁচে থাকতে পারে না। একঘেয়ে সুখের মাঝে এই নবরসঘন আনন্দের আস্বাদনও হয়তো বিস্বাদ হয়ে আসে। সৃষ্টির সুকুশলী শিল্পী কি যে চায় আমাদের জীবন ক’টি নিয়ে, সেই-ই তা’ জানে। তার হিসাব কিতাব আমাদের প্রাণের ও আকুল হৃদয়ের চাওয়া পাওয়া সাধ আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আজও কিছুতেই মিললো দু’বছর যেতে না যেতে আমাদের গোমস্ লেনের সুখের ঘরে আগুন লাগলো। এইখানে এসেও রাঙ্গা মায়ের কোলে বসে আমার প্রথম হাতে খড়ি, এক জন প্রাইভেট টিউটরের কাছে প্রথম ইংরাজী শিক্ষা। কাঠের মত কঠিন মুখ, কল্পনাশক্তি বিরহিত, নিতান্তই কাজের মানুষ বি এ পাশ এই মাষ্টার পুঙ্গবের হাতে আমি শিখেছিলুম যত না, নির্ম্মম কানমলা খেয়েছিলুম ততোধিক। রাঙ্গা মায়ের কড়া শাসনের ভয়ে তটস্থ এই প্রথম শিক্ষাগুরুটির আড়ে আবডালে দেওয়া ধমক ও কর্ণমলায় আমার লেখাপড়ার ওপর প্রথম বিতৃষ্ণা জন্মাল, পড়ার বইগুলোকে মনে হতে লাগল দাঁতবেরকরা খেঁকী কুকুর—আমার যত দুঃখ দুর্দ্দশা ও অশান্তির ওরাই মূল। মুষড়ে পড়া নিরন্তর সন্ত্রস্ত মন নিয়ে পড়ার বই হাতে গেঙিয়ে চলা সে যে কি বিড়ম্বনা তা’ আমাদের মাষ্টার ও বাপ মা তাড়িত কত না হুকুমার চিত্ত বালক বোঝে! আমি যখন গ্যাঙাতুম মাষ্টার তখন চেয়ারে বসে ঢুলতেন। তারপর জেগে উঠে পড়া না পারার অপরাধে কাণ লাল করে চড় চাপড় মেরে আমায় বিদ্যা দান করে বিদায় হতেন। আমিও সে দিনকার মত ছুটি পেয়ে বাঁচতুম। গোমস্ লেনের জীবনে ষোলকলায় পূর্ণ আনন্দের চাঁদে এই লেখা পড়া শেখাটাই ছিল কলঙ্ক। প্রত্যেক শিশুচিত্ত স্বভাবতঃ যা’ চায়, যে দিকে তার মনপ্রাণ সারা সত্তা সহজেই উন্মুখ হয় সেই দিককার জ্ঞান যদি তার কাছে ছেলেবেলা থেকে ধীরে ধীরে খেলাধূলা আনন্দের মধ্যে মেলে ধরা যায় তা হলে জ্ঞানচর্চ্চাটা আর বিভীষিকা হয়ে দাঁড়ায় না। আমাদের জীবনে যখন শৈশব ও কৈশোরের উদ্বেল প্রাণ গতিহীন হয়ে এসেছে, সে স্বতঃস্ফূর্ত উপচে-পড়া আনন্দ আর নেই, সংসারের স্বার্থবুদ্ধি দাঁড়িপাল্লা ধরে তার মুদিখানায় দু’ পয়সার কেনা-বেচায় বসে গেছে; তখন আমরা হয়ে বসি গুরু মশাই। অহেতুক উচ্ছল আনন্দের মূর্ত্তি শিশুগুলির হিসাবকিতাব-হারা প্রাণকে সংসারী আমরা আমাদের স্বার্থবুদ্ধির পাঁচন বাড়ি নিয়ে তাড়া করে ঢোকাতে চাই আমাদের সঙ্কীর্ণ ভাল মন্দের গোয়ালে। অনেক ক্ষেত্রে এর ফলে কি যে নির্ম্মম অত্যাচারের সৃষ্টি হয় তা কোপন মা বাপের ঘরে বেদম শিশু ঠ্যাঙানী দেখেই বেশ বোঝা যায়। যারা শিশু, বালক ও যুবকের স্বভাব বোঝে না তাদের হাতে শিশুপালনের ও শিক্ষা-দীক্ষার ভার দেওয়া আর বদ্ধ উন্মাদকে সহজ মানুষের সুখ শান্তির হর্ত্তা কর্ত্তা করা একই কথা। নিজের নিজের সঙ্কীর্ণ মত ও জিদের দিক দিয়ে আমরা সবাই একগুঁয়ে পাগল, হয় monomaniac নয় megalomaniac। মানুষের কোমল, জটিল ও সুকুমার মন-প্রাণ রূপ যন্ত্রটি নিয়ে যে নাড়াচাড়া করবার অধিকার পাবে তার দৃষ্টি হবে কতখানি বহুদিকদর্শী, সূক্ষ্ম ও অনুকম্পা এবং দরদে কোমল sensitive!

 আমার জীবনের কথা বলতে বলতে প্রতি কথায় এই যে লেকচার দেবার ধারা—এই অবান্তর কথার পুনঃ পুনঃ অবতারণা, এটা গল্প-রসিক অনেক পাঠক পাঠিকার হয়তো ভাল লাগছে না। কিন্তু উপায়ান্তর নেই, আমার জীবন আমার চোখে একটি অতি চিত্তাকর্ষক চাণক্য নীতির বই; জীবনের প্রতিপদে প্রতি অলি গলির বাঁকে কত শিক্ষাই যে এ আমাকে দিয়েছে তার হিসাব কিতাব নেই, সে সব এড়িয়ে এ জীবন-কথা বলতে যাওয়া বিড়ম্বনা। নিছক গল্প-রসপিপাসুরা না হয় কমা সেমিকোলনের মত ছেদ বিরামের হিসাবে এগুলো বাদ দিয়েই পড়বেন।

 এক দিন ভোর চারটে রাত্রে উঠে রাঙ্গা মা আমার কাঁদতে লাগলেন, আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, দেখো ধন, উনি বুঝি আর নেই, আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন; আমার বুকের ভেতর যেন কেমন করছে। এখনি স্বপ্ন দেখছি যেন কাছে এসে গা ঠেলছেন আর বলছেন ‘ওগো উঠে দেখো, আমি যাচ্ছি।’ উঠে—দেখি সত্যিই জলজীয়ন্ত সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ধরতে গেলেই মিলিয়ে গেলেন।” সেই যে রাঙা মা কাঁদতে বসলেন বেলা দশটা অবধি তা’ থামলো না।

 আমি বাইরের ঘরে খেলা করছি। তখন বোধ হয় বেলা এগারটা কি বারটা। কয়েকজন সাহেব এসে বাড়ী ঢুকলেন, একজন আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করে বললেন, “তোমার মা কোথায়?”

 আ। ভেতরে আছেন।

 সা। তোমার বাবা ডক্টর কে ডি ঘোষ? খুলনার সিভিল সার্জ্জন?

 আ। হ্যাঁ।

 সা। তাঁর সম্প্রতি কোন অসুখ হয়েছিল?

 আ। কৈ, না।

 সা। তিনি মারা গেছেন, তোমার মাকে খবর দিতে পার?

 খবরটা শুনে আমার ভিতরে কোন দুঃখেরই সাড়া পেলুম না, শিশু ও বালকের চিত্ত তরল, স্নেহ ভালবাসাও নিম্নগামী, সচরাচর বড়র দিক থেকে ছোটর দিকে নামে। আমি মাকে খবর দিতে নারাজ হওয়ায় সাহেব ক’জন মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলেন। ইনি বলেন, ‘তুমি বল’, উনি বলেন, ‘না বাপু তুমি বল, আমি পারবো না।’ শেষটা আমাকে দিয়ে মাকে ডাকিয়ে একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার স্বামী ডক্টর কে ডি ঘোষ?’ মা পরদার আড়ালে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছিলেন, এই কথায়ই কেঁদে লুটিয়ে পড়লেন। তাঁর গভীর প্রেম প্রেমাস্পদের চিরবিরহের সংবাদ আগেই পেয়েছিল, আর বাবার এতবড় ভালবাসার এই জীবন সঙ্গিনীকে আমার ব্রাহ্ম আত্মীয়রা ঠাউরেছিলেন বাজারের বেশ্যা। মানুষের পেঁচার মত দিককাণা বুদ্ধি আর ধর্ম্মজ্ঞান কতদূর হীন হতে পারে তার দৃষ্টান্ত বাবার মৃত্যুতে আমি সাধারণ সমাজের লোকের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের মধ্যে পেয়েছি। তা যথাস্থানে যৎকিঞ্চিৎ বল্‌বো।

 সাহেবরা কোন গতিকে নির্ম্মম কাজটা সেরে চলে গেলেন, নির্ব্বান্ধব এই জনবহুল নগরের মাঝে অসহায় মা আমার আমাদের বুকে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন। যত বড়ই শোক হোক মানুষ সন্তানের স্নেহে তা সামলে নেয়, নিরাভরণ শুভ্র বৈধব্য বেশে শোকশয্যা থেকে উঠে মা বাবার বন্ধু ব্যারিষ্টার মনোমোহন ঘোষের সঙ্গে নিজে গিয়ে দেখা করলেন। এতদিন পর সংবাদ পেয়ে কাকা এলেন, দেওঘরবাসী আমার মাতামহের প্রতিনিধি হয়ে ন-মেশো শ্রীযুক্ত কৃষ্ণকুমার মিত্র মশাই এলেন, বাগবাজারের পিসীরা এলেন, আত্মীয় স্বজনরা সব একে একে দেখা দিতে লাগলেন। বাবার জীবিতকালে কাকাদের, দেওঘরবাসী মাতামহদের ও ন-মেশোমশাইদের কারু সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক ছিল না। ছিল কেবল বাবার দিকের দু’চারটি মানুষের সঙ্গে। আমার বড় পিসী বিধবা বিরাজমোহিনী আসতেন আমাদের গোমস লেনের বাড়ীতে, আমার পিসতুত বোন গোলাপ দিদি বাবার খুব প্রিয়পাত্রী ছিলেন। তিনি তখন দুই তিন ছেলের মা, বাবা দেখেছি তাঁকেও কোলে করে ছোট মেয়েটির মত আদর করতেন। আন্দামান থেকে ফিরেও এ শ্যামবর্ণ শান্ত প্রকৃতি গোলাপ দিদির সঙ্গে আমি দেখা করেছি, তাঁর মুখে ছিল একটি অনুপম শ্রী, সুন্দরী না হ’লেও যা’ মানুষকে মুগ্ধ করতো।

 রাঙা মা আমাদের নিয়ে পিসীর বাড়ী যেতেন, তাঁরাও মাঝে মাঝে তত্ত্ব তালাস নিতেন, আসতেন-যেতেন। একবার বাবা দিনকতকের জন্যে দেশভ্রমণে যান— কাশী, এলাহাবাদ, জব্বলপুর ইত্যাদি। ছেলেপুলেদের বাবা জিজ্ঞেস করলেন “কে আমার সঙ্গে যাবে বল?” আমি তখনই রাজী হই, শেষটা বাবা, একজন চাকর ও আমি যাত্রা করলুম। সে ভ্রমণের কথা অতি ক্ষীণ অস্পষ্ট ছবির মত আমার মনে আছে। রাঙামা আমায় কতকগুলি গান শিখিয়েছিলেন, তার মধ্যে কৃষ্ণ বিষয়ে এই গানটী গেয়ে কাশীতে আমার অতি বৃদ্ধা ঠাকুরমাকে কাঁদিয়ে দিয়েছিলুম বলে আমার মনে আছে,

“আর তো ব্রজে যাব না রে ভাই,
যেতে প্রাণ নাহি চায়;
ব্রজের খেলা ফুরিয়ে গেছে,
তাই এসেছি মথুরায়।
মা ছেড়েছি, বাপ ছেড়েছি,
ব্রজের খেলা ভুলে গেছি,

তোমরা সবাই মা বলে ভাই,
ভুলিয়ে রেখো মা যশোদায়।”

ঠাকুর মা তখন উঠতে পারেন না, চোখের দৃষ্টি ও তাঁর গেছে, বড় পিসী তাঁর সেবা করেন। বাবার মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে কোলের কাছে টেনে নিয়ে ঠাকুরমা তাঁকে কোলের শিশুর মত আদর করতেন, আমায় চোখে দেখতে পেতেন না বলে তাঁর কি দুঃখ! জব্বলপুরের মার্ব্বল পাহাড় ও জলপ্রপাত আমার এখনও মনে আছে, এলাহাবাদে একটা কি মেলায় বাজী পুড়ছিল, আতস বাজী দিয়ে রাম লক্ষণ হনুমান রাবণ সব করা হয়েছিল। একটা বিপুল মাঠে অনন্ত জনসমুদ্র আমার আজও মনে বিস্মৃতির মাঝে ডুবে যায়নি। আর মনে আছে ইংরাজি হোটেলে এক এক প্লেট ভরে কাটলেট খাওয়া। সেই হোটেলে সাহেবী কেতায় আমরা আশ্রয় নিয়েছিলুম। বাবা চলে যেতেন কাজে কর্ম্মে আমাকে চাকরদের কাছে রেখে—যা’ চাই তাই দেবার হুকুম জারি ক’রে। আমি আর চাকরটি পরামর্শ করে এক একবারে এক এক ডজন কাটলেট অর্ডার দিতুম, বলাই বাহুল্য তার অনেকগুলো যেতো লোভী চাকরটির উদর নামক গহ্বরে।

 বাবার মৃত্যুর পর কাকা একদিন কি দুদিন এসেছিলেন, তারপর আমাদের আশ্বাস ও সান্ত্বনা দিয়ে তিনি ভাগলপুর চলে যান। শ্রীকৃষ্ণকুমার মিত্র প্রায়ই আসতেন, একদিন তাঁর বড় মেয়ে কুমারী রত্ন বা কুমুদিনীকে এনেছিলেন। আমাদের মাসতুত বোনেদের মধ্যে সেই ছিল সব চেয়ে সুন্দরী। সেই যে আমার তার ওপর টান হলো সে ভালবাসা আজও আমি কাটিয়ে উঠতে পারি নি, যদিও আমাদের দেখা সাক্ষাৎ ক্কচিৎ কখনও হয়। আমার তখন জগতের স্বার্থবুদ্ধি খুব ভাল রকম হয় নি, তবু বৈষয়িক কাণ্ড নিয়ে যে সব ব্যাপার আমাদের চার পাশে ঘটছিল তা’ আমি কতক কতক বুঝতুম। বাবার উইল মনোমোহন ঘোষের বাড়ীতে পড়া হ’লো, তাতে তিনি আমার গর্ভধারিণী মা স্বর্ণলতার ব্যবস্থা করে সমস্ত টাকা ও বিষয়-আশয় এবং ছেলে মেয়ের ভার রাঙা মায়ের হাতে দিয়ে যান। এই নিয়ে আমার নীতিবাগীশ আত্মীয়দের সঙ্গে মায়ের বাধলো লড়াই। এক দিকে অসহায় অর্দ্ধশিক্ষিত আইনের প্যাঁচে ক’ অক্ষয় গোমাংস হিন্দু বিধবা আর একদিকে সমাজের ও পরিবারের গুরুগম্ভীর বিদ্বান নীতিচঞ্চু অভিভাবকের দল। এরকম ক্ষেত্রে কোন্ পক্ষের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী তা সহজেই অনুমেয়।