বাংলাদেশের জাতিগোষ্ঠী
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট কিন্তু জনবহুল রাষ্ট্র। বাংলাদেশ ভূখন্ডের জনসংখ্যার অধিকাংশ হচ্ছে বাংলাদেশের বৃহৎ নৃগোষ্ঠী বাঙালি। এছাড়া অনেকগুলো উপজাতি রয়েছে। বাংলাদেশের উপজাতির সংখ্যা প্রায় ১৬ লক্ষ ৫০ হাজার ৪৭৮ জন; সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় এক শতাংশের মতো (০.৯৯%)। বাংলাদেশের উপজাতির অধিকাংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহ, সিলেট ও রাজশাহী অঞ্চলে বসবাস করে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উপজাতি হল চাকমা। এছাড়া রয়েছে গারো, মারমা, ম্রো, খেয়াং, চাক, বম, লুসাই, পাংখোয়া, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, মনিপুরী ইত্যাদি। এছাড়া বাংলাদেশে কিবেশ কিছু উপজাতিদের বসবাস রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩ (ক) তে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’[১]
বাঙালি
[সম্পাদনা]বাংলাদেশের প্রধান ও বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিকগোষ্ঠী হলো বাঙালি জাতিগোষ্ঠী। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতে (মূলত পশ্চিমবঙ্গে) অনেক বাঙালি বসবাস করে। বাঙালি জাতি কয়েকটি উপভাগে বিভক্ত। বাংলাদেশে বাঙালিরা প্রধানত ঢাকাইয়া, সিলেটি, চাঁটগাইয়া, নোয়াখালিয়া, বরিশালিয়া, রংপুরি ইত্যাদি কয়েকভাগে বিভক্ত।
বাঙালি জাতির উদ্ভব হয়েছে মৌলিকভাবে আর্য জাতিগোষ্ঠী থেকে। তাই বাঙালি জাতিকে ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং বাংলা ভাষাকে ইন্দো-আর্য ভাষা-পরিবারের একটি ভাষা হিসেবে অভিহিত করা হয়। যদিও বাঙালি নৃগোষ্ঠী সংকর জাতিগোষ্ঠী হিসেবেও অধিক পরিচিত। এজন্য বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী যেমন অস্ট্রিক, দ্রাবিড়দের বৈশিষ্ট্যও লক্ষ্য করা যায়। এবং ভাষার ব্যবহারেও ইন্দো-আর্য ভাষা বাদেও বাংলা ভাষায় অস্ট্রিক ভাষা এবং দ্রাবিড় ভাষার উপস্থিতি লক্ষণীয়।
উপজাতি সম্প্রদায়সমূহ
[সম্পাদনা]বাংলাদেশের এই ভূখণ্ডে (পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ) আদিকাল থেকে মূলত বাঙালি নৃগোষ্ঠীর বৃহৎ পরিসরে বসবাস বিদ্যমান ছিল। তবে বাঙালি নৃগোষ্ঠীর উদ্ভবের আগে এই বাংলা অঞ্চলে বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। এই বাংলা অঞ্চলে আর্যদের আগমনের পূর্বে অনার্য বা আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠীগুলো যেমন - নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠী।
বাংলা অঞ্চলে প্রথম মানবগোষ্ঠী হিসেবে আগমন ঘটেছিল নেগ্রিটোদের। এরপর অস্ট্রিক নরগোষ্ঠী এসে নেগ্রিটোদের পরাজিত করে এখানে বসতি স্থাপন করে। এক সময় অস্ট্রিকদের সংখ্যাধিক্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তির ফলে নেগ্রিটোরা ক্রমশ এই অঞ্চল থেকে বিলীন হয়ে যায়। এরপর আগমন ঘটে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর। দ্রাবিড়রা অস্ট্রিকদের সাথে লড়াই করে এই বাংলা অঞ্চলে বসতি গড়তে সমর্থ হয়। দ্রাবিড়দের আগমনের পর মঙ্গোলীয় বা ভোটচীনীয়দের আগমন ঘটেছিল এই অঞ্চলে। অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড়দের সাথে শক্তি ও সামর্থ্যে টিকে থাকতে না পেরে মঙ্গোলীয়রা এই অঞ্চল পরিত্যাগ করে। এরপরেই পুরো ভারতবর্ষসহ এই বাংলা অঞ্চলে আর্যদের আগমন ঘটে। পরবর্তীতে আর্য, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় এসব নরগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে বাঙালি নৃগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়।
বাংলাদেশের প্রথম উপজাতি হলো এই অস্ট্রালয়েড বা অস্ট্রিক নরগোষ্ঠীর মানুষেরা। বর্তমানে বাংলাদেশের সাঁওতাল, কোল, ভিল, ভূমিজ, মুন্ডা, বাঁশফোড়, মালপাহাড়ি, পুলিন্দ, শবর ইত্যাদি নৃগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ হলো এই অস্ট্রিক নরগোষ্ঠী। অর্থাৎ এরাই অস্ট্রিক নরগোষ্ঠীভুক্ত এই বাংলা অঞ্চলের প্রাচীনতম উপজাতি।
এছাড়া এই অঞ্চলে অস্ট্রিকদের পরে আসা দ্রাবিড়দের বর্তমানে তেমন কোনো উত্তরপুরুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতে এদের অধিক হারে বসবাস রয়েছে। ভারতের নিকটতম দেশের বিচারে এদের দেখা যায় মূলত শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তানে। তেলেগু, তামিল, কন্নড়, মালায়ালম, ব্রাহুই ইত্যাদি ভাষাতাত্ত্বিক পূর্বপুরুষ হলো দ্রাবিড়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়াতে তামিলদের একটি বড় অংশ বসবাস করে। বাংলাদেশের দ্রাবিড়রা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সাথে মিশে গেছে। এই বিচারে বিশুদ্ধ দ্রাবিড় বাংলাদেশে ততটা দেখা যায় না। তবে পাহাড়িয়া, ওরাওঁ এই দুইটি জাতিগোষ্ঠী এখনও দ্রাবিড় থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ দ্রাবিড় নৃগোষ্ঠীভুক্ত এই দুটি জাতিগোষ্ঠী এদেশের প্রাচীন উপজাতি হিসেবে বিবেচিত।[২][৩]
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতি সমূহের তালিকা ও সংখ্যা
[সম্পাদনা]পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে বাংলাদেশে উপজাতিদের সংখ্যা ৫০। এগুলো হচ্ছে:
- চাকমা (৪ লক্ষ ৮৩ হাজার ৩৬৫ জন)
- মারমা (২ লক্ষ ২৪ হাজার ২৯৯ জন)
- সাঁওতাল (১ লক্ষ ২৯ হাজার ৫৬জন)
- ত্রিপুরা (১ লক্ষ ৫৬হাজার ৬২০ জন)
- গারো/আ·চিক (৭৬ হাজার ৮৫৪ জন)
- ওঁরাও (৮৫ হাজার ৮৫৮জন)
- তঞ্চ্যঙ্গা (৪৫ হাজার ৯৭৪জন)
- ম্রো (৩৯ হাজার ৪ জন)
- বম (১২ হাজার ৪২৪ জন)
- পাংখো (দুই হাজার ২৭৪ জন)
- চাক (দুই হাজার ৮৩৫ জন)
- খেয়াং (তিন হাজার ৮৯৯ জন)
- খুমি (তিন হাজার ৩৬৯ জন)
- লুসাই (৯৫৯ জন)
- কোচ (১৬ হাজার ৯০৩ জন)
- ডালু (৮০৬ জন)
- কুকি (৩৪৭ জন)
- রাখাইন (১৩ হাজার ২৫৪ জন)
- মণিপুরী (২৪ হাজার৬৯৫ জন)
- হাজং (৯ হাজার ১৬২ জন)
- খাসিয়া বা খাসি (১১ হাজার ৬৯৭ জন)
- মং (২৬৩ জন)
- বর্মন (৫৩ হাজার ৭৯২ জন)
- পাহাড়ি (পাঁচ হাজার ৯০৮ জন)
- মালপাহাড়ি (দুই হাজার ৮৪০ জন)
- মুন্ডা (৩৮ হাজার ২১২ জন)
- ভূমিজ
- কোল (২ হাজার ৮৪৩ জন)
- কন্দ
- পাঙন
- লাওরা
- মুরং (২০,০০০-২৫,০০০ জন)
- রাজবংশী
- পাত্র (৩০০০ জন)
- গণ্ড
- বাগদী
- ভিল (৯৫ জন)
- টিপরা
- রনজোগী
- হো
- খারিয়া/খাড়িয়া
- খারওয়ার/খেড়োয়ার
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ jagonews24.com। "উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী"। jagonews24.com (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২২-০৯-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-২০।
- ↑ "বাংলাদেশের ইতিহাস"। onushilon.org। ২০২২-০৯-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-২০।
- ↑ অস্ট্রালয়েড, নরগোষ্ঠী। "বাংলাপিডিয়া"। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২।